‘ছোট্ট অতিথি’: গাজায় হারিয়ে যাওয়া শিশু মায়ার বন্ধনে বাঁধল দুই পরিবারকে

ছোট মোহাম্মদ এখন তার বাবার দুই বাহুর মাঝে। সে নিখোঁজ হওয়ার পর যে পরিবারটি তার দেখভাল করেছে, তাঁদের সঙ্গে সে খুশি মনে খেলছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের মুখে একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল মোহাম্মদের পরিবার। প্রায় ১৬ মাস আগে ওই স্কুলে বোমা হামলা চালান ইসরায়েলি সেনারা। হামলার পর চারপাশে পড়ে ছিল হতাহত মানুষের দেহ। এর মধ্যেই মাত্র ১৩ মাস বয়সী মোহাম্মদ তার মায়ের নিথর দেহের পাশে বসে কাঁদছিল।
সে দিন বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো যখন আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মধ্যে পালাচ্ছিল, তখন মোহাম্মদ সেখান থেকে হারিয়ে যায়।
তার বাবা তারেক আবু জাবাল এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মোহাম্মদকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। অথচ তিনি জানতেন না, ওই স্কুলে থাকা আরেকজন মানুষ তারেককে খুঁজে ফিরছিলেন।
‘একটি ছোট্ট অতিথি’
রাসেম নাবহান ও তার পরিবারও বাস্তুচ্যুত হয়ে উত্তর গাজার জাবালিয়ায় আল-রাফেই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে দুটি ইসরায়েলি বোমা সে স্কুলে আঘাত হানে।
৪১ বছর বয়সী রাসেম বলেন, ‘আমরা ভীষণ আতঙ্কিত ছিলাম, বাচ্চারা চিৎকার করছিল। কয়েক মুহূর্ত পর সেখানে একটি ড্রোন এসে হাজির হয়। সেখান থেকে সবাইকে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা জারি করা হচ্ছিল। চারদিক থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসছিল।’
এই পরিবারের বাস্তুচ্যুত হওয়ার কাহিনি দীর্ঘ ও জটিল—স্কুল থেকে একটি বাস্তুচ্যুত শিবির, সেখান থেকে একটি তাঁবুতে খুব কঠিন পরিবেশে মাসের পর মাস ঘুমাতে হয়েছে।
রাসেম প্রথমে তাঁর স্ত্রী ও সাত সন্তানকে অন্য নারী ও শিশুদের সঙ্গে স্কুল থেকে বের করে দেন। তারপর দৌড়ে দগ্ধ শ্রেণিকক্ষগুলোতে ফিরে যান আগুন নেভাতে এবং কেউ বেঁচে আছে কি না, সেটি দেখতে।
রাসেম বলেন, ‘দেয়ালগুলো রক্তে ভিজে গিয়েছিল। আহত ও নিহত ব্যক্তিদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়েছিল। ওই দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করার মতো না।’
এই গাজার বাসিন্দা বলেন, ‘এই বিভীষিকার মধ্যেই আমি দেখতে পেলাম, এক শিশু কাঁদছে। তার পাশে পড়ে আছে এক নারীর দেহ। তাঁর মাথা আর পেট ছিন্নভিন্ন। শরীর রক্তে ভেজা। মনে হলো, ওই নারীই শিশুটির মা।’
কিছু না ভেবেই রাসেম শিশুটিকে তুলে নিয়ে ছুটে যান। তিনি বলেন, ‘শিশুটির মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। সে এত জোরে কাঁদছিল যে, দম নিতে পারছিল না।’
রাসেম বলেন, ‘আমি আশপাশের সবাইকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, ‘এই শিশুকে কেউ চিনো? তার মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কেউ চিনতে পারেনি। এটি ছিল দুঃসহ অভিজ্ঞতা। আমার কাছে মনে হয়েছিল কেয়ামত ঘটে যাচ্ছে। সন্তানদের আঁকড়ে ধরে সবাই ছুটে পালাচ্ছে।’
রাসেম বলেন, ততক্ষণে কিছু ট্যাংক স্কুলটিকে ঘিরে ফেলেছিল। সবাইকে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছিল। তিনি শিশুটিকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে সড়কের পাশে অপেক্ষা করতে থাকা তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে পৌঁছান। তিনি বলেন, ‘আমি শিশুটিকে আমার স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, তাকে আমি স্কুলে পেয়েছি। তার মাকে মেরে ফেলা হয়েছে।’
রাসেমের স্ত্রী ৩৪ বছর বয়সী ফাওয়াকেহ নাবহান শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। তাদের দুই মেয়ে ইসলাম (১৯) ও আমিনা (১৮) শিশুটিকে কোলে নেওয়ার জন্য উত্সাহিত হয়ে ওঠে।
ফাওয়াকেহ বলেন, ‘এক মুহূর্তের জন্য সব ভয় মুছে গেল। আমরা ছোট্ট অতিথিটিকে স্বাগত জানালাম। তার মুখটা ছিল অপূর্ব সুন্দর। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি গভীর টান অনুভব করলাম।’ রাসেম যখন কথা বলছিলেন, তখন পাশে বসে ছিলেন মোহাম্মদের বাবা তারেক (৩৫)। ছোট ছেলেটিকে মায়াভরা চোখে দেখছিলেন তিনি। তাঁর মুখে লেগে ছিল মৃদু হাসি।
এই দম্পতি শিশুটির নাম রাখেন হামুদ, যা মোহাম্মদ ও আহমেদের আদুরে রূপ। শিশুটিকে নিয়েই তাঁরা দক্ষিণে রাসিদ সড়কের দিকে হাঁটতে থাকেন, পেরিয়ে যান ইসরায়েলি বাহিনীর নেতসারিম তল্লাশিচৌকি।
শিশুটিকে কোলে নেওয়ার দায়িত্ব ভাগ করে নেন রাসেম, ফাওয়াকেহ এবং তাঁদের দুই মেয়ে।
ফাওয়াকেহ বলেন, ‘সে আমাদের কোলেই ঘুমিয়ে পড়ত আবার জেগে উঠত। অন্য যেকোনো শিশু যেমনটি করে। সে জানত না, তার চারপাশে কী ঘটছে।’
আপন হয়ে ওঠা
শিশুটির বয়স ঠিক কত ছিল, তা পরিবারটি জানত না। তবে তার গড়ন ও ওজন দেখে তারা অনুমান করেছিল, সে সাত থেকে নয় মাস বয়সী হবে।
ফাওয়াকেহ বলেন, ‘আমরা তাকে এর আগে কখনো স্কুলে দেখিনি। তার প্রকৃত বয়স বা জন্মদিন সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।
রাসেম ও তাঁর পরিবার হেঁটে গাজা উপত্যকার মাঝামাঝি অঞ্চলের দেইর আল-বালাহতে পৌঁছান এবং কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর দক্ষিণের খান ইউনিসের দিকে রওনা হন। সেখানকার আরেকটি স্কুল–আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু জায়গা খালি আছে বলে তাঁরা শুনেছিলেন।
ফাওয়াকেহ বলেন, ‘সব ঝুঁকি সত্ত্বেও আমি মনে করেছিলাম, তাবুতে থাকার চেয়ে স্কুলে থাকা ভালো। অন্তত মাথার ওপর পাকা ছাদ তো থাকবে।’
এই পরিবারের বাস্তুচ্যুত হওয়ার কাহিনি দীর্ঘ ও জটিল—স্কুল থেকে একটি বাস্তুচ্যুত শিবির, সেখান থেকে একটি তাঁবুতে খুব কঠিন পরিবেশে মাসের পর মাস ঘুমাতে হয়েছে।
এই পুরো সময়ে রাসেম ও ফাওয়াকেহ শিশুটিকে উষ্ণতা আর আনন্দের উৎস হিসেবে দেখেছিলেন। রাসেম বলেন, ‘প্রথম দিকে সে ছিল একেবারে চুপচাপ। যতই চেষ্টা করতাম, সে হাসত না। প্রায় ৫০ দিন ধরে সে এমনই ছিল—যেন সে তার মাকে খুঁজছিল আর ভাবছিল আমরা কারা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে ধীরে ধীরে মিশতে শুরু করল। সে আমাদের আপন করে নিল আর আমরা তার আপন হয়ে উঠলাম।’ এই পুরোটা সময় ফাওয়াকেহ ও তাঁর মেয়েরা শিশুটির যত্ন নিয়েছেন। তবে তাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব ফাওয়াকেহ নিজেই পালন করতেন।
রাসেম নাবহান ও তার পরিবারও বাস্তুচ্যুত হয়ে উত্তর গাজার জাবালিয়ায় আল-রাফেই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে দুটি ইসরায়েলি বোমা সে স্কুলে আঘাত হানে।
কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার মধ্যে একটি শিশুর দেখভাল করা মানে বড় ধরনের আর্থিক চাপের মুখে পড়া। কারণ, সেখানে দুধ, ডায়পার ও পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায় না বললেই চলে। আবার পাওয়া গেলেও এসবের দাম নাগালের বাইরে।
ফাওয়াকেহ বলেন, ‘আমরা দক্ষিণে পৌঁছে তার জন্য দুধ কিনি। কিন্তু সে খেতে চাইত না। মনে হয়, তার মা তাকে বুকের দুধ খাওয়াতেন। একদিকে এটাও স্বস্তিরও ছিল। কারণ, দুধের দাম অনেক বেশি। তার বদলে আমি তাকে মসুর ডাল, শিম ও ভাত খাওয়াতাম। আমরা যা খেতাম, সেও তা–ই খেত।’
আশীর্বাদ
রাসেম জানান, পরিবারটি যখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছিল, তখন শিশুটি তাদের পরিচিত ও প্রিয় মুখ হয়ে উঠেছিল। তাদের জীবনে আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিল।
ফাওয়াকেহ গলা নিচু করে তাঁর ছোট ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘শিশুটি আমার স্বামীকে বাবা বলে ডাকত, আর আমাকে মাম্মা। সে আমার কোলে ঘুমাত। আমি যখন শিশুটিকে একটু বেশি সময় দিতাম, তখন আমার চার বছরের ছেলে আবদুল্লাহ খুব ঈর্ষান্বিত হতো এবং কেঁদে ফেলত।’
বিভিন্ন সংস্থা, অনাথ শিশুদের পৃষ্ঠপোষক কর্মসূচি, এমনকি কিছু পরিবারও শিশুটিকে দত্তক নিতে চেয়েছিল। কিন্তু রাসেম দৃঢ়ভাবে তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘সে আমার অষ্টম সন্তান। আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমি কখনোই তাকে কাউকে দিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করিনি। তাদের প্রতি আমার উত্তর সবসময় একটাই ছিল—শুধু তার প্রকৃত পরিবারকে খুঁজে পেলেই তাকে যেতে দেব।’
তারপর রাসেম নিচুস্বরে স্বীকার করেন: ‘মনে মনে আমি প্রার্থনা করছিলাম, যেন আমি তার পরিবারকে খুঁজে না পাই। আমি তাদের খোঁজাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমরা একে অপরের অনেক আপন হয়ে গিয়েছিলাম।’
এক বাবার ছুটে চলা
রাসেম যখন কথা বলছিলেন, তখন পাশে বসে ছিলেন মোহাম্মদের বাবা তারেক (৩৫)। ছোট ছেলেটিকে মায়াভরা চোখে দেখছিলেন তিনি। তাঁর মুখে লেগে ছিল মৃদু হাসি।
তিন সন্তানের জনক তারেক—ওমর (১৪), তুলায় (৯) এবং এখন ২৬ মাস বয়সী মোহাম্মদ। এক মুহূর্তের জন্যও নিখোঁজ ছেলেকে খোঁজা বন্ধ করেননি তিনি।
তারেক বলেন, ‘যেদিন আল-রাফি স্কুলে ইসরায়েল বোমা হামলা চালায়, সেদিন আমার স্ত্রী আর তিন সন্তান আমাদের শ্রেণিকক্ষেই ছিল। আমি তখন স্কুলের মাঠে ছিলাম। আকাশ থেকে বোমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিলাম। চিৎকার করে ছুটে গেলাম তাদের কাছে।’
ইসরায়েলি বাহিনী শুধু আল-রাফি নয়, পাশের স্কুলটিতেও নির্বিচার গোলাবর্ষণ করেছিল। তারেক বলেন, ওই হামলায় আমার স্ত্রী, ভাগ্নে এবং আরও ছয়জন নিহত হয়। এক ঝটকায় আটটি প্রাণ ঝরে গেল।
তারেক আরও বলেন, ‘আমি যখন শ্রেণিকক্ষে পৌঁছাই, দেখি ওমর আর তুলায় আহত। ওমরের পিঠে বোমার টুকরো ঢুকে গিয়েছিল। আর আমার মেয়ের পেটে আঘাত লেগেছিল। এরপর আমি আমার স্ত্রীকে দেখতে পাই। তাঁর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।’
বলতে বলতে তারেকের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। তিনি আরও বলেন, ‘আমি ভেঙে পড়ি। কিন্তু কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে নিয়ে তাঁর মরদেহ সেখান থেকে বের করে আনি।’
তারেকের স্ত্রী ইমান আবু জাবাল ছিলেন ৩৩ বছর বয়সী। তুলায় তিন মাস পেটে বোমার টুকরা নিয়ে বেঁচে ছিল।
তারেক বলেন, ‘শোক, আহত সন্তানদের জন্য ভয়, চারপাশে চিৎকার, আতঙ্কে পালানোর তাড়া—এসবের মধ্যে আমি যখন বড় দুই সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে আসি, তখন মোহাম্মদকে আনতে ভুলে যাই।’
পরে তারেক ফিরে গিয়ে মোহাম্মদকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু ছেলেকে কোথাও খুঁজে পাননি। সে হারিয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি সবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি। কেউ বলেছে সে মারা গেছে, আবার কেউ বলেছে—একজন তাকে নিয়ে গেছে। গল্পগুলো বদলে যাচ্ছিল বারবার।’
তারেক বলেন, ‘আমি ভেঙে পড়েছিলাম। ভিড়ের ভেতর মোহাম্মদকে খুঁজছিলাম। কিন্তু সবাই তখন দৌড়াচ্ছিল, চিৎকার করছে এবং যার যার সন্তানকে নিয়ে পালাচ্ছে।’
মোহাম্মদকে খুঁজে না পেয়ে তারেক কয়েকজনের সঙ্গে স্কুলে ফিরে যান নিহত ব্যক্তিদের কবর দিতে। তিনি বলেন, ‘আমরা আমার স্ত্রীর মরদেহ চাদরে মুড়িয়ে একটা ক্লাসরুমে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিলাম। কারণ, বাইরে বেরিয়ে স্কুলের মাঠে গিয়ে তাঁকে কবর দেওয়া তখন অসম্ভব ছিল। ইসরায়েলের গোলাবর্ষণ আর গুলিবৃষ্টি চলছিল। কিন্তু আমি যেকোনো মূল্য স্ত্রীর দাফন করতে চেয়েছিলাম।’
স্কুলে যাঁরা প্রিয়জনদের মরদেহ উদ্ধার করে কবর দিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সন্তানদের নিয়ে সেখানেই রাত কাটান তারেক। সকালে তাঁরা স্কুলের দেয়ালের একটি ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে বেরিয়ে আসেন। তারেক বিভিন্ন ঘুরপথ পেরিয়ে পশ্চিম জাবালিয়ায় তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে পৌঁছান।
বড় সন্তানদের সেখানে রেখে তারেক সারা দিন জাবালিয়ার বিভিন্ন হাসপাতাল আর আশ্রয়কেন্দ্রে মোহাম্মদের খোঁজ করতে থাকেন। এ সময় কেউ তাঁকে বলেছে, একটা পরিবার মোহাম্মদকে দক্ষিণে নিয়ে গেছে। আবার কেউ বলেছে, তাঁরা কিছুই জানে না।
এর মধ্যেই তারেককে অন্য সন্তানদের দিকে নজর দিতে হয়েছিল। চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখা সন্তানদের তখন খাদ্য, ওষুধ আর যত্নের দরকার ছিল।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। ফলে সন্তানদের বাঁচাতে তারেক দক্ষিণে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
রাফাহতে পৌঁছানোর পরপরই তারেক আবার মোহাম্মদের খোঁজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আত্মীয়স্বজন, পরিচিত মানুষ আর স্কুল থেকে যারা আমাদের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল, তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসা করতাম। কিন্তু কেউ মোহাম্মদের খোঁজ দিতে পারেনি। এভাবেই দিন কাটাতে লাগল। শেষমেশ আমি সব আশা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম।’
তারেক আরও বলেন, ‘আমি দেখতাম, মানুষ পালাচ্ছে, বোমার আঘাতে বা তাড়াহুড়ায় তাদের সন্তানদের ফেলে রেখে যাচ্ছে। দেখতাম হারিয়ে যাওয়া শিশুরা কাঁদছে…তখন আমার নিজের ছেলের কথা মনে পড়ত।’
সন্তানকে ফিরে পাওয়া
২৭ জানুয়ারি যখন বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে উত্তর গাজায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন আবু জাবাল এবং নাভহান পরিবার হেঁটে জাবালিয়ায় ফিরে আসেন।
তারেক আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সকাল ৮টার দিকে, আমি ও আমার সন্তানেরা জাবালিয়ায় আমাদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভোর ৪টায় আমরা রওনা দিয়েছিলাম, আর ধৈর্য ধরতে পারছিলাম না।’
রাসেম ও ফাওয়াকেহর পরিবার একটু পরে রওনা দেয়। পথে এক সাংবাদিক তাঁদের থামিয়ে সাক্ষাৎকার নেন।
রাসেম বলেন, ‘নিজ এলাকায় ফিরে যাচ্ছি। সে জন্য কত আনন্দ হচ্ছিল, তাই বলছিলাম। হঠাৎ ওই সাংবাদিক শিশুটিকে নিয়ে প্রশ্ন করলেন। ভাবলেন, সে আমার ছেলে। আমি বললাম, সে আমার সন্তান নয় এবং পুরো ঘটনাটা বললাম। তিনি এতটাই আবেগে আপ্লুত হলেন যে টিভিতে সরাসরি অনুরোধ করলেন—কেউ যদি শিশুটিকে চিনে থাকেন, যেন যোগাযোগ করেন।’
পরিবারটি শেষ পর্যন্ত রাসেমের মা–বাবার বাড়িতে পৌঁছায়। পরে জানতে পারে, হামুদের আসল পরিবারের কাছাকাছিই ছিল তারা।
পরদিন সকালে তারেক ওই টিভি সাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখতে পান। তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদের চেহারায় তেমন পরিবর্তন হয়নি। শুধু একটু বড় হয়েছে। আমি ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিলাম, আমার ছেলে বেঁচে আছে! আমার ছেলে মোহাম্মদ বেঁচে আছে! আমার ভাই, তার স্ত্রী, পরিবার ও আশপাশের প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসে—কী হয়েছে জানতে।’
তারেক আরও বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে ভিডিওটা দেখি। রাসেমের মুখ চেনা লাগছিল। কারণ, আমরা একই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলাম।’
খোঁজখবর নিয়ে রাসেমের পরিবার কোথায় আছে, তা জেনে নেন তারেক। তিনি দৌড়ে সেখানে পৌঁছান।
তারেক বলেন, ‘আমি, আমার সন্তান ও ভাই মিলে সেখানে গেলাম। নিজের পরিচয় দিলাম। রাসেম সঙ্গে সঙ্গে আমাকে চিনে ফেলেন। মোহাম্মদ আমাকে চিনতে পারেনি। সে কেঁদে ফেলেছিল।’
নাভহান পরিবার দ্বিধায় পড়ে যায়। একদিকে তাঁরা খুশি যে হামুদ—যার প্রকৃত নাম মোহাম্মদ—পরিবারকে ফিরে পেয়েছে। অন্যদিকে তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে ভেবে তাঁদের গভীর দুঃখ ছেয়ে ফেলেছিল।
রাসেম বলেন, ‘মনে হচ্ছিল নিজের আত্মার একটা অংশ ছেড়ে দিচ্ছি। সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত ছিল, যখন ও চলে যাচ্ছিল আর কাঁদতে কাঁদতে আমাকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে ডাকছিল।
ফাওয়াকেহ অশ্রুভরা চোখে বলেন, ‘হামুদকে হারানোর দুঃখে আমি রাতে বসে বসে কেঁদেছি। আমার মেয়েরা পুরো এক সপ্তাহ কেঁদেছে। ঘরটা যেন শোকগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। হামুদ আমাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে গিয়েছিল। এসব কথা যখন বলছিলেন, তখনো তিনি মোহাম্মদকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। সে এখনো তাঁকে ‘মা’ বলেই ডাকে।
ফাওয়াকেহ বলেন, ‘আমি আমার স্বামী ও তারেককে বলেছিলাম, হামুদ যেন মাঝেমধ্যে আমাদের দেখতে আসে। সে আমাদের সন্তানের মতো এবং সে আমার জীবনে গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে।’